মেলাতেই সব বই প্রকাশ করার প্রবণতা বন্ধ হোক

দেশের সবকিছু রাজধানীতে কেন্দ্রিভূত করার মতো বই সংক্রান্ত সবকিছু কেন্দ্রিভূত হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। মেলার সময় একমাসে প্রকাশিত হয় প্রায় সাড়ে চার হাজার বই। আর বাকি ১১ মাসে বড়জোর সংখ্যাটি ৫০ হতে পারে। উত্সবের আমেজে ভুলে গিয়ে আমরা এই অস্বস্তিকর (এবং কিছুটা অসুস্থও) প্রবণতাটিকে স্থায়ী রূপ দিতে চলেছি।

বই তো নির্দিষ্ট সময়বন্দি হবার কথা নয়। কিন্তু হয়ে গেছে। একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি, এই একমাসে সাড়ে ৪ হাজার বইকে আমরা কীভাবে পরিচিত করাতে পারব পাঠকের কাছে? আদৌ কি তা করা সম্ভব? কয়টা বইয়ের খবর পাঠক জানতে পারে? পত্র-পত্রিকাগুলো এই মাসে বইয়ের জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ করে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া বইমেলার সময় বই এবং লেখক পরিচিতির অনুষ্ঠান করে। কিন্তু তা তো যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট হতে পারেও না। হয়তো এক ঝলক প্রচ্ছদ এবং লেখককে দেখানো যায়। কিন্তু বইটি সম্পর্কে কি কোনো ধারণা দেবার অবকাশ পাওয়া যায়? যায় না। ফলে নির্দিষ্ট কিছু লেখকই পরিচিত হবার সুযোগ পান প্রতি বছর।
তাছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসে বই বের করতে হবে, সেই তাগাদা থেকে শুরু হয় প্রেসকর্মী, কম্পোজিটর, প্রুফরিডার, প্রচ্ছদশিল্পী, বাঁধাইকরদের ওপর বাড়তি চাপ। ফলে বেশিরভাগ বইয়ের প্রকাশনাই মানসম্মত হতে পারে না। সম্পাদনার বালাই তো থাকেই না বলতে গেলে। ফলে বইতে থাকে মুদ্রণপ্রমাদ, বাক্যগঠনে ভুল এবং আরো অনেক বিরক্তিকর অনুষঙ্গ।
মেলা হোক। কিন্তু সব বই মেলাতেই প্রকাশ করতে হবে, এমন মানসিকতা দূর হোক। আরেকটি জিনিস খুব দৃষ্টিকটূ লাগে। দেখা যায়, পরিচিত কাউকে পেলেই লেখক-কবিরা তাদের বই গছিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন নির্লজ্জভাবে। এর নাম ‘পুশ সেলিং’। এটি পাঠকের জন্য যেমন অস্বস্তিকর, লেখকের জন্য তার চাইতে বেশি অবমাননার। নিজের আত্মসম্মানকে বিকিয়ে দেওয়ার সামিল।
যে জায়গাটি সবচেয়ে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন অহংকারী কবি-লেখকদের সমাবেশ হবার কথা, সেই লিটল ম্যাগাজিন কর্নারেই এই ‘গছিয়ে দেওয়া’র ব্যাপারটি বেশি ঘটে। সেই কারণে অনেক ভুক্তভোগী পাঠক লিটল ম্যাগাজিন কর্নার এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেন।
শত শত মৌসুমী লেখকের আবির্ভাব বইমেলার নিয়মিত ঘটনা। এরা সবসময় টিভি আর পত্রিকার রিপোর্টারের সঙ্গে সেঁটে থাকার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে জীবনের অন্য ক্ষেত্রে কৃতি, সফল এবং ধনাঢ্যরা মাসজুড়ে পত্রিকাতে-টেলিভিশনে নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারেন অদীক্ষিত পাঠকের। তার বিজ্ঞাপন দেখে অনেক পাঠক কেনেন বই এবং মাথা নেড়ে বলতে থাকেন-- বাংলাদেশের সাহিত্যের মান এত নীচু!

লেখক :কথাসাহিত্যিক
মেলাতেই সব বই প্রকাশ করার প্রবণতা বন্ধ হোক মেলাতেই সব বই প্রকাশ করার প্রবণতা বন্ধ হোক Reviewed by Prothomkantho on 10:37 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.